Friday, April 11, 2008

ঘূর্ণিঝড়


ঋতু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ফাল্গুন শেষে গ্রীষ্মকাল এসে গেছে। শুরু হয়ে গেল ঝড়বৃষ্টির মৌসুম। বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে প্রধানত এটাকেই বোঝানো হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যাকেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় রাখা হয়েছে, কিন্তু তা ঝড়ের মত ততোটা আকস্মিক ও ভয়ংকর নয়।

বিষুব রেখার ৩০ ডিগ্রী উত্তর ও ৩০ ডিগ্রী দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল। এই অংশেই সবচাইতে বিধ্বংসী ঝড়গুলোর তাণ্ডবলীলা চলে। প্রশান্ত মহাসাগর, মেক্সিকো উপসাগর, আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চল, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এর আওতায় পড়ে। এর মধ্যে বাংলাদেশ হল আর্দ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা। দক্ষিণ আটলান্টিক এবং দক্ষিণ পূর্ব মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট ঝড়গুলোকে ঘূর্ণিঝড় বলা হয় না। পৃথিবীতে প্রত্যেক বৎসরে গড়ে ৯০-১০০টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। এর মধ্যে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ঝড়গুলো প্রচণ্ড ক্ষতিকর ও বিধ্বংসী হয়ে থাকে।

< সাইক্লোন সিডর (SIDR)

সাইক্লোন (Cyclone) শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ কাইক্লাস থেকে। এর অর্থ 'কুণ্ডলী পাকানো সাপ'। বৃটিশ আমলের দক্ষিণ উপমহাদেশীয় আবহাওয়া বিভাগের পরিচালক ড. হেনরি পিডিংটন এর লেখা ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত 'দি সেইলরস হর্ন বুক ফর দি ল অফ স্টর্মস' বইতে প্রথম সাইক্লোন শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

সাইক্লোন সৃষ্টি হওয়ার কারণটি বেশ মজার। সাগরের জলরাশির ঠিক উপরিভাগের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কোন কারণে বেড়ে যদি যায়। তাহলে হালকা গরম বাতাস দ্রুতগতিতে উপরে উঠে যায় এবং ওই শূন্যস্থানটির বায়ুচাপ কমে যায়। তখন চারপাশ থেকে অপেক্ষাকৃত শীতল ও ভারী বাতাস এসে জায়গাটি পূর্ণ করে। এই বাতাস কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ওই শূন্য স্থানে আসে। ভারী বাতাসের এই নিচের দিকে গতিপ্রবাহকে নিম্নচাপ বলে। এই নিম্নচাপ সময়ের সাথে সাথে শক্তি সঞ্চয় করে। ক্রমান্বয়ে তা ভয়ংকর শক্তি সঞ্চয় করে কোন একদিক অভিমুখে গতি লাভ করে। সাইক্লোনের বাতাস উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাটার উল্টো দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাটার দিকে চক্রাকারে কেন্দ্রের চারদিকে প্রবাহিত হয়।

চারপাশ থেকে বাতাস সংগ্রহ করতে করতে সাইক্লোনের আয়তন ও গতি অনেক বেড়ে যায়। আয়তন ভেদে একটি সাইক্লোন ৩০০ কিমি থেকে ৬০০ কিমি ব্যাসার্ধের হতে পারে। এত বিরাট আকারের একটি সাইক্লোনের গতিবেগ ১১৮ কি.মি. এর উপরে হয়ে থাকে। এসময় কেন্দ্রে বায়ুর চাপ ৫০ থেকে ৬০ হেক্সা প্যাসকেল পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে কখনও কখনও এর চাইতেও বেশি হতে পারে। একটি সাইক্লোন তার আশেপাশ থেকে প্রচুর পরিমাণ জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে। সেজন্য সাইক্লোন আক্রান্ত এলাকায় তীব্র ঝড়ের সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টিও হয়।

স্থানভেদে ঘূর্ণিঝড়ের নাম ভিন্নরকম। আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলের ঝড়গুলোকে বলে হারিকেন, দক্ষিণ চীন সাগরে সৃষ্ট ঝড়গুলোকে বলে টাইফুন। আর সাইক্লোনের পূর্ণ নাম হল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোন। আমরা সংক্ষেপে সাইক্লোন বলে থাকি।

হারিকেন ক্যাটরিনা >

ঘূর্ণিঝড়ের চোখ বলতে তার কেন্দ্রকে বোঝানো হয়। উপগ্রহ থেকে নেয়া চিত্রগুলোতে স্পষ্ট দেখা যায় যে ঘুর্ণিপ্রবাহের কেন্দ্রের বিন্দুর মত জায়গাটি তারই নাম চোখ। এই অংশটির ব্যাস ৮-৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এর তাপমাত্রাও থাকে অনেক বেশি। তাই এখানে বায়ুর চাপ কম হয়। এই চোখের তাপমাত্রা যত বেশি উষ্ণ হবে ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাও তত বেশি হবে। চোখের বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ হালকা হয়। সাধারণত ২৫- ৩০ কি.মি. এর বেশি হয় না। চোখের বাইরে ১০-১৫ কি.মি. অঞ্চলটিকে বলা হয় চোখের দেয়াল। এখানের বাতাসের গতিবেগ প্রচণ্ড হয় সাথে থাকে প্রবল বৃষ্টি।

ঘূর্নিঝড়ের অন্যতম অনুষঙ্গ হল জলোচ্ছ্বাস। যদি জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড় হয় তাহলে জোয়ার ভয়াল রূপ ধারণ করে। এর উচ্চতা তখন ১২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। ঘুর্ণিঝড়ের উর্ধ্বগামী বাতাস সাগরের জলকে টেনে উপরে তোলে সাথে স্থলভূমি অভিমুখী বাতাসের তীব্র গতিবেগ জলকে আরও স্ফীত করে তোলে।

বাংলাদেশে প্রত্যেক বৎসর কমপক্ষে ৫টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। গতবছরের ১৫ নভেম্বর সিডর নামে একটি ঘুর্ণিঝড় উপকূলবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকায় প্রচণ্ড আঘাত হানে। গত ১৩১ বৎসরের মধ্যে সংঘটিত ঝড়গুলোর মধ্যে এর শক্তি সবচেয়ে বেশি ছিল। এর আকার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার বর্গকি.মি.। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হিসাব মতে এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২৬০-২৮০ কিলোমিটার। সাফিন সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী নাসা সিডরকে চার নম্বর ক্যাটাগরিভুক্ত করেছে। টাকার অঙ্কে প্রায় ১৬,১০০ কোটি টাকার সম্পদ এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রেডক্রিসেন্টের হিসাব মতে ১০,০০০ এবং বাংলাদেশ সরকারের মতে মারা গেছে ২,২৯৯ জন মানুষ।

ছবিগুলো নেয়া হয়েছে উইকিপিডিয়া থেকে।

0 টি মন্তব্য:

Post a Comment

আপনার প্রাসঙ্গিক মন্তব্য, ভাবনা, ভিন্নমত প্রকাশ করুন। প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে না চাইলে ইমেইল করুন।