শিশুরা আরও বলতে চায়
সুশান্ত বর্মন
সুশান্ত বর্মন
পূর্ণবয়স্ক নারী পুরুষমাত্রই স্বপ্ন দেখে একটি শিশুর। প্রধানত এজন্যই মানুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বহুদিনের স্বপ্ন যখন বাস্তবে পরিণত হয় তখন পিতামাতার আনন্দের সীমা থাকে না। আনন্দের প্লাবনে তাদের পৃথিবী উপচে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে পুষ্পকলির মত শিশু বেড়ে ওঠে। ১ দিন ২ দিন করে পার হয় আর শিশুর শরীর বাড়তে শুরু করে। তারপর অর্থহীন কিছু শব্দ দিয়ে প্রকাশ করে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই পর্যায়ে কিছু অতিরিক্ত মনোযোগের খুব দরকার।
লক্ষ্য করা যায় যে শিশু কথা বলা যখন শিখে যায় তখন যে প্রচুর কথা বলে। চারপাশের অচেনা জগতকে চিনে নেবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় সে প্রশ্ন করা শুরু করে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন, অজস্র প্রশ্ন এসে তার মগজে জমা হয়। ঘনিষ্ঠজনকে প্রশ্ন করে জেনে তৃপ্ত করতে চায় তার নতুন কৌতুহল। কিন্তু বড়রা বেশিরভাগ সময় এটা মেনে নিতে পারে না। শিশুর কৌতুহলপ্রবণতাকে ধমকের আঘাতে সঙ্কুচিত করতে চায়। শিশু বাধ্য হয় চুপ করতে। অজানাকে জানার স্পৃহা তার ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে পরে। বিপরীতে কিছু কিছু জন্ম হয় বাকশক্তিহীন হয়ে। জন্ম থেকে তাদের শারীরবৃত্তিয় একাধিক কারণে তারা কথা বলতে পারেনা। এর মধ্যে প্রধান কারণ হল কানের সমস্যা। দেখা গেছে কানের কোন জন্মগত ত্রুটির কারণে কথা বলতে না পারা শিশুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। কানের ত্রুটির কারণে তারা পরিপার্শ্বের কোন শব্দ শুনতে পারেনা। তাদের পৃথিবী হয়ে পরে শব্দহীন, নীরব নিথর। শব্দকে চিনতে না পারার কারণে তারা কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না বা চায় না।
শিশুর কথা বলার ইচ্ছা বা নতুন কিছু জানার আকাঙ্ক্ষা সাধারণ মানুষের কাছে বাচালতা হলেও বিজ্ঞানীদের কাছে তার অর্থ ভিন্নরকম। কারণ শিশু কিভাবে কথা বলা শেখে বা ভাষা আয়ত্ব করে এ ব্যাপারে সঠিক তথ্যের পরিমাণ খুব কম। শব্দময় এই জগতে একটি শিশু ঠিক কিভাবে নতুন শোনা শব্দকে হৃদয়ঙ্গম করে কিংবা নিজের মগজে কিভাবে একটি শব্দকে অনুধাবন করে এ বিষয়টা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও দুর্বোধ্য।
বধির শিশুদেরকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা শিশুদের ভাষার উপর দখল লাভের প্রচেষ্টাকে গভীর মনোযোগের সাথে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। যে সমস্ত শিশু কানের সমস্যার কারণে বধির হয়ে যায়, তাদের কেউ কেউ ককলিয়ার প্রতিস্থাপন করলে সুস্থ হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট কম্ব রিলে হাসপাতালের বিজ্ঞানীরা শ্রবণসক্ষমতার মাধ্যমে শিশুর ভাষাদক্ষতা অর্জনের বিষয়টিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাদের প্রধান অনুসন্ধানের বিষয় হল - শুনে শুনে কিভাবে একটি শিশু ভাষার উপর দখল প্রতিষ্ঠা করে? এর সাথে সাথে আরো কিছু প্রশ্ন বিজ্ঞানীদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। ভাষা আয়ত্ব করার পদ্ধতি তাদের কিরূপ? চারপাশের বিচিত্র ধ্বনিগুলো কিভাবে তাদের বোধগম্য হয়? একজন সুস্থ শিশুর মত ককলিয়ার প্রতিস্থাপন করা শিশু কি একই রকমভাবে বিভিন্ন শব্দের পার্থক্য বুঝতে পারে? শিশুরা যা দেখে তার সাথে শোনা শব্দকে কিভাবে তারা মিলিয়ে নেয় বা আলাদা করে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা হলে গবেষকরা শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের অগ্রগতিকে আরো ভালভাবে বুঝতে পারবেন। যাদের কানের ককলিয়ার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে কিংবা যাদের স্পিচ থেরাপি দেয়া হচ্ছে তাদের চিকিৎসার অগ্রগতি পরিমাপ করা আরও সহজ হবে।
সদ্যজন্ম হওয়া একটি শিশুর কাছে এই জগৎটা বিস্ময়কর। দৃশ্যমান প্রতিটি বস্তুই সে চিনে নিতে চায়। এজন্য সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বস্তুটিকে চিনে চিনে চায়। শিশুর এই সহজাত আচরণটি বিজ্ঞানীদের প্রধান কৌতুহলের বিষয়। বিজ্ঞানীরা বলেন - শিশুর চোখের নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করলে তার ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি বোঝা সহজ হবে। এই একটি বিষয়কে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারলে আমরা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারব।
বিভিন্নরকম উদ্দীপক যেমন: শব্দ বা আলো ইত্যাদি শিশুকে সহজে আকৃষ্ট করে। এ ধরণের উদ্দপনাতে শিশু তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়। তারা বিভিন্নরকম শব্দকে কিভাবে আলাদা করে এবং এই সাফল্য তাদের ভাষা শিক্ষায় কিরকম প্রভাব ফেলে তা বিজ্ঞানীরা পরিমাপ করতে পেরেছেন। কোন একটি নির্দিষ্ট বস্তুর দিকেএকটি শিশু কখন বা কতক্ষণ তাকিয়ে থাকল তার উপর এই পরিমাপ পদ্ধতি নির্ভর করে। একটি সহজ পরীক্ষা দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পিতা অথবা মাতার সাথে শিশুকে একটি অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে। তাদের সামনে রয়েছে বড় পর্দার টিভি। টিভির উপরে লুকানো আছে একটি ক্যামেরা। এই পরীক্ষায় দেখা গেছে ৫ থেকে ১৩ মাস বয়সী শিশুরা তাদের সামনে থাকা মহিলার মুখের দুইরকম প্রতিচ্ছবি দেখে। দুইরকম প্রতিচ্ছবিতর উচ্চারিত শব্দ দুইরকম হবে না কি একটিমাত্র শব্দ হিসেবে শিশু গ্রহণ করবে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এতদিন সংশয়ে ছিলেন। যদি সঠিকভাবে ঠোঁট নাড়ানোর উপর শিশুর ভাষা শিক্ষার বিষয়টি নির্ভর করে তারপরও বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে এই সমস্যার উত্তর রয়েছে শিশুর চোখে।
আর একটি পরীক্ষায় দীর্ঘক্ষণ ধরে শিশুকে লাল ও সাদা ডোরাকাটা প্যাটার্ন দেখানো হয়েছে। এর পাশাপাশি একবার বিভিন্নরকম শক্দ শোনানো হয়েছে আবার কখনও কোন শব্দ শোনানো হয়নি। এই পরীক্ষায় দেখা গেছে সুস্থ শ্রবণশক্তির শিশুরা মুখ দিয়ে উচ্চারিত শব্দের প্রতি বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা বিভিন্নরকম শব্দের মধ্যে মানবীয় শব্দকে আলাদা করতে পারে। কিন্তু কানের ককলিয়ার প্রতিস্থাপিত শিশুদের ক্ষেত্রে ফলাফল কিছুটা ভিন্নরকম। তারাও বিভিন্ন শব্দের পার্থক্য ধরতে পারে তবে তার জন্য কিছুটা সময় ব্যায় করতে হয়। ককলিয়ার প্রতিস্থাপন করার সাথে সাথে তারা শব্দ চিনতে পারেনা। এর জন্য এক মাসেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে জন্ম থেকে কানে শোনেনা এমন শিশুদের সাথে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের মৌলিক পার্তক্য কোথায় তার কার্যকারণ অনুসন্ধান বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও জটিল বিষয়। তারা বিভিন্ন রকম ছবি, শব্দ ও উদ্দীপক ব্যবহার করে সমস্যাটির গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই গবেষণাকর্মের প্রধান ড. ডেরেক এম হাউস্টোন বলেন - সাধারণ শিশুরা হঠাৎ করে হওয়া শব্দের উৎসের দিকে সরাসরি তাকায়। কিন্তু যারা বধির হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেছে কিংবা যাদের কানের ককলিয়ার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তাদের আচরণ এক্ষেত্রে ভিন্নরকম। একই রকম হঠাৎ করে হওয়া শব্দ তাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না। শিশুদের ভাষা শিক্ষার কৌশল বোঝার সাথে সাথে এই সমস্যাটিও আমরা বুঝতে চাই।
শিশুর ভাষা শিক্ষা গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা অন্য আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশেষ অভিনিবেশ সহকারে কাজ করে যাচ্ছেন। শিশুদের ভাষা আয়ত্ব পদ্ধতিকে অনুধাবনের বিষয়ে পিতামাতাদের কতটা আগ্রহ বা মনোযোগ আছে এটা বিজ্ঞানীরা জানতে চান। ড. হাউস্টোনের সহকারী গবেষক ড. বেরগেসন বলেন - আমাদের এ বিষয়ে আরেকটি প্রজেক্ট আছে। আমরা জানতে চাই মায়েরা ঠিক কেন স্বত:প্রণোদিত হয়ে শিশুদের সাথে কথা বলে। মজার ব্যাপার হল যে সব শিশুদের ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করা হয়েছে তাদের শ্রবণ বয়সের (Hearing age) দিকে মায়েরা খেয়াল রাখে। কতদিন আগে শিশুর কানে অস্ত্রপোচার করা হয়েছিল তার উপর শ্রবণ বয়স নির্ভর করে। বিজ্ঞানীদের আবিস্কৃত পন্থায় ১২ মাস আগে কানের ককলিয়ার প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল এমন ২০ মাস বয়সী শিশুর শ্রবণ বয়স হল ১ বৎসর। এ ধরণের শিশুর সাথে তাদের মা যখন গল্প করে তখন শ্রবণবয়সটার কথা তাকে মনে রাখতেই হয়। না হলে শিশুর সাথে যোগাযোগ ঠিকভাবে স্থাপন করা যায় না। এটা মায়েরা তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে অনুভব করে। গবেষণাকার্য চলাকালে অবুঝ শিশুরা/ দুগ্ধপোষ্য শিশুর (Infants and toddlers) কি বলতে চায় তা ড. হাউস্টোন ও বেরগেনসন গভীর মনোযোগের সাথে শুনেছেন। তাঁরা লক্ষ্য করেছেন শিশুরা কিছু একটা বলতে চায়। যে শব্দটি তারা শিখেছে তা তারা বলতে চায়। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ শেষে গবেষকরা একটি সিদ্ধান্তে এসেছেন। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন - শিশুর উচ্চারিত শব্দগুলি সাধারণ শিশুতোষ শব্দের চাইতেও অনেক বেশি। আমাদের দৃষ্টিতে তার কোন অর্থ নাও থাকতে পারে কিন্তু শিশুর কাছে তা তার মর্মোচ্চারণ। সে বড়দের মত নিজেও কিছু বলতে চায় এবং নিজের ভাষায় তা সে বলে। যা আমরা মূল্যায়ন করি না।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন বড়রা যদি শুধুমাত্র একটুখানি ধৈর্য ধরে শুনতো তাহলে শিশুরা অনেককিছুই বলতো। তারা বলতে চায়। শ্রুত শব্দকে তাদের নিজের মত করে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে চায়। বড়রা যদি শিশুদের কথার প্রতি ভালো শ্রোতা হত তাহলে তাদের ভাষাশিক্ষার গতি অনেক বেড়ে যেত। ভাষাকে আয়ত্ব করার সামর্থ বেড়ে যেত কয়েকগুণ।
0 টি মন্তব্য:
Post a Comment
আপনার প্রাসঙ্গিক মন্তব্য, ভাবনা, ভিন্নমত প্রকাশ করুন। প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে না চাইলে ইমেইল করুন।