সারা পৃথিবীর দুই ভাগ জল ও এক ভাগ স্থল। এই বিশাল জলরাশির বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য দ্বীপ খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলোর কোনটি রাজনৈতিকভাবে আবার কোনটা অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছু কিছু দ্বীপ বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছে তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। গালাপাগস তেমনি একটি দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপমালায় প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক চার্লস ডারউইন কয়েকমাস থেকেছেন। বিস্ময়কর ও রহস্যময় অসংখ্য পশুপাখিতে পরিপূর্ণ দ্বীপগুলোতে ভ্রমণ করে ডারউইন প্রাণীর সৃষ্টি ও বিকাশের সূত্রটি খুঁজে পেয়েছেন। এই দ্বীপের বিভিন্নরকম প্রাণী নিজেদের নানারকম বৈচিত্র্য ডারউইনের কাছে তুলে ধরে প্রমাণ করেছে মানুষ পতনের ফল নয়; উৎকর্ষের ফল।
অদ্ভূত ধরণের প্রাণী দিয়ে পূর্ণ এই দ্বীপমালার কথা প্রথম জানা যায় ১৫৩৫ সালে। ফ্রে টমাস নামে একজন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারকারী জাহাজে করে পেরু যাচ্ছিলেন। পথে বেশ কিছু দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দ্বীপপুঞ্জের দেখা পেলেন। সেখানে তিনি অনেক অদ্ভূত অদ্ভূত গাছপালা ও প্রাণী দেখলেন। তিনি দেখলেন এই দ্বীপমালার প্রাণীজগতের বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের প্রাণীদের চাইতে একেবারে আলাদা রকম। তিনি সেখানে বিদঘুটে ডিজাইনের গিরগিটি, বিশাল বিশাল কচ্ছপ, বিভিন্ন ধরণের ঠোঁটওয়ালা একই জাতের পাখি, কাঁটাওয়ালা নাশপাতি গাছ ইত্যাদি দেখতে পেলেন। তাঁর সহ জাহাজের সবার দৃষ্টি কেড়েছিলো কচ্ছপগুলো। এগুলোর সাইজ এত বিরাট যে কয়েকজন মানুষকে পিঠে নিয়ে চলাফেরা করা এদের কাছে কোন ব্যপার নয়। পরম আনন্দে তারা মাংসের জন্য জাহাজ ভর্তি করে কচ্ছপ নিয়ে নিলো। দ্বীপগুলোর নাম রাখলেন গালাপাগস। স্পানিস ভাষায় গালাপাগস অর্থ কচ্ছপ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দ্বীপটিতে এমন কিছু বিচিত্র প্রাণীর নমুনা রয়েছে যা পৃথিবীর আর অন্য কোথাও নেই। অন্য কোন দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথেও গালাপাগস দ্বীপমালার পরিবেশ মেলেনা। সারা বছর প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা এই দ্বীপে থেকে গবেষণা করেন। প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের কাছে স্বর্গসদৃশ এই দ্বীপ ৬৫টি ছোট ও ১৩টি প্রধান দ্বীপ নিয়ে গঠিত। সবচাইতে বড়টির নাম ইসাবেলা। এছাড়াও আছে ফার্নান্দেজ, সান্টিয়াগো, মারচনাপিন্টা, জোনো, ভেসা, পিনজোন ইত্যাদি নামের দ্বীপ। গালাপাগস দ্বীপে অনেক রকমের পাথর ও জীবাশ্ম (Fossil) পাওয়া গেছে। এগুলোর C12 পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বোঝা যায় দ্বীপটি গঠিত হয়েছে ৩৫ লক্ষ বছর আগে। সমস্ত দ্বীপটি আসলে একটি বড় পাহাড় দিয়ে গঠিত। এখানে বেশ কয়েকটি মৃত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এই আগ্নেয়গিরিগুলির লাভা উদগীরণের ফলে দ্বীপগুলোর সৃষ্টি হয়। আবহাওয়া প্রায় শুকনো। বছরের অনেক সময় খরা থাকে। হঠাৎ হঠাৎ সেখানে বৃষ্টি হয়। সেখানকার স্পানিস লোকেরা এই হঠাৎ বৃষ্টির নাম দিয়েছে 'এল নিনো'। বৃষ্টির পরপর দ্বীপমালার চিত্র দ্রুত পাল্টে যায়। চারিদিক সবুজ ঘাসে ভরে যায়, রুক্ষ্ম পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি বন্য ফুল ফুটে থাকে। পাখিরা ছড়িয়ে পড়ে সারা দ্বীপে। দ্বীপমালাটির আবহাওয়া ও ভূমি কিছুটা রুক্ষ্ম হলেও সেখানে প্রাকৃতিক দৃশ্য ও প্রাণীজ বৈচিত্রের কোন কমতি নেই। স্থলভূমিতে দেখা যায় অনেক রকমের পাখি। টিয়ে, কাকাতুয়াসহ বিভিন্ন রকমের পাখি; বিশাল সাইজের টিকটিকি জাতীয় প্রাণী ও ছোট ছোট প্রাণী রয়েছে এই দ্বীপটিতে। তবে ডাঙ্গার তুলনায় গালাপাগস দ্বীপের জলজ প্রাণীরা অধিকতর বৈচিত্র্যময়। দ্বীপটি বিষুব অঞ্চলীয় হলেও সেখানে সীল রয়েছে প্রচুর। এছাড়া রয়েছে উড়ুক্কু মাছ, বিভিন্ন ধরণের হাঙর, কয়েক রকমের তিমি, বিভিন্ন জাতের অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য মাছ। গালাপাগস দ্বীপের সবচাইতে রাজকীয় প্রাণীটি হলো কচ্ছপ। গালাপাগস দ্বীপমালার প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায় বিশাল বিশাল সব কচ্ছপ। পাশ দিয়ে যাওয়া বেশিরভাগ জাহাজযাত্রীরা এই এলাকায় এসে প্রাচীনকাল থেকে এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত কচ্ছপ শিকার করে নিয়ে যেতো। এছাড়াও এই দ্বীপটিতে রয়েছে বিশাল বিশাল আকৃতির শুকর। সাধারণ শুকরের আকার যেখানে সর্বোচ্চ ৫/৬ মন হয় সেখানে এই শুকরগুলোর ওজন হয় ৮/১০ মন। খাদ্য হিসেবে কচ্ছপের পাশাপাশি শুকরগুলির চাহিদা এখনও খুব রয়েছে।
0 টি মন্তব্য:
Post a Comment
আপনার প্রাসঙ্গিক মন্তব্য, ভাবনা, ভিন্নমত প্রকাশ করুন। প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে না চাইলে ইমেইল করুন।