Tuesday, March 25, 2008

শুঁয়াপোকাদের স্মৃতিশক্তি


সুশান্ত বর্মন

হামাগুড়ি দেয়া কিলবিলে শুঁয়াপোকা (Caterpillar) থেকে পূর্ণবয়স্ক বর্ণিল ডানাওয়ালা প্রজাপতিতে রূপান্তরের বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর! শুধুমাত্র শারীরিক রূপান্তর নয়। এর মাধ্যমে জীবন ব্যবস্থা, মানসিকতা বা স্মরণশক্তির কি পরিবর্তন ঘটে তা জানার আগ্রহ বিজ্ঞানীদের অনেকদিনের। শৈশবে একটি শুয়াপোকা কি কিছু শিখতে পারে? যা শেখে তা কি সে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মনে রাখতে পারে? এমনি নানা প্রশ্ন বিজ্ঞানীদেরকে সবসময় আলোড়িত করত। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এটা আবিষ্কার করেছেন যে প্রজাপতি বা মথ শৈশবে যা শেখে তা বড় হওয়ার পর মনে করতে পারে।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের (Georgetown University) গবেষকরা বিভিন্ন গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে হালকা বিদ্যুৎ শক দেয়ার সাথে সাথে কোন একটি বিশেষ দুর্গন্ধকে এড়িয়ে যাওয়াটা তামাকে হর্ণওয়ার্ম শুঁয়াপোকাকে শেখানো যায়। প্রশিক্ষিত শুঁয়াপোকা যখন পিউপা (Pupa) থেকে মথ (Moth) হিসেবে বের হয়, তখন তারা ঐ বিশেষ দুর্গন্ধকে এড়িয়ে চলে। এটা প্রমাণ করে যে তাদের স্মৃতিশক্তি আছে। তারা তাদের শৈশবের প্রশিক্ষণকে মনে করতে পেরেছে। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটাই প্রতম যেখানে পতঙ্গের স্মৃতিশক্তি নিয়ে একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে। এই গবেষণার মাধ্যমে আরও একটি নতুন প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। পতঙ্গের রূপান্তরকালীন সময়ে তার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ কিভাবে হয় তা এতদিন বিজ্ঞানীদের নিকট অজানা ছিল। আলোচ্য গবেষণাটি এই বিশেষ দিকটির দিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করেছে।

লার্ভা (Larva) বা শুঁয়াপোকার পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গে রূপান্তর (Metamorphosis) হওয়ার বিষয়ে এতদিন বিজ্ঞানীরা তেমন কিছু জানতেন না। ধারণা করা হত যে শুঁয়াপোকারা পিউপা অবস্থায় সম্পূর্ণ তরল হয়ে যায় এবং এই তরলাবস্থা থেকে ডানাওয়ালা বর্ণিল শরীরটি পুনর্গঠিত হয়। নতুন গবেষণা এ মজার ধারণাটির প্রতি বেশ ভাল রকমের একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। শুয়াপোকা অবস্থার অভিজ্ঞতা পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতির স্মৃতিতে থেকে যায় - এটা সত্যিই বিস্ময়কর। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গবেষক আচরণগত পরিবেশবিদ সহযোগী অধ্যাপক মার্থা ওয়েজ প্রসঙ্গক্রমে বলেন - পুরনো ধারণা এখন পরিণত হয়েছে হাস্যকর আলোচনায়।

শৈশবে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা পতঙ্গের স্মৃতিতে কতদিন স্থায়ী হয় এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের যথেষ্ঠ কৌতুহল রয়েছে। "হয়তো ১০০ বৎসর" -বলেন সহযোগী গবেষক ডাউ ব্লাকিস্টন। তিনি আরও বলেন -পিউপার ভিতরে থাকাকালীন সময়ে পতঙ্গের মগজ এবং স্নায়ুতন্ত্র নতুনভাবে সন্নিবেশিত হয়। কিন্তু ঠিক কিভাবে স্মৃতির ছাপ থেকে যায় এটা এখনও পরিষ্কার নয়। পিউপার অভ্যন্তরে রূপান্তরকালীন সময়ে তাদের স্মৃতি কিভাবে অমোচনীয় থেকে যায় তা এখনও রহস্যজনক।

গবেষকরা দেখেছেন যে প্রাথমিক স্তরের শুয়াপোকাদের স্মৃতিশক্তি কম কার্যকর। ডিম থেকে বের হওয়ার পর ১-২ সপ্তাহ বয়সী শুয়াপোকাদের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা কম। বিজ্ঞানীদের আরোপিত উদ্দীপনায় তাদের মগজ কম সাড়া দিয়েছে। কিন্তু ৩ সপ্তাহের বেশী বয়সী শুয়াপোকারা বেশ দ্রুত শেখে। লব্ধ জ্ঞান তাদেরই বেশী মনে থাকে। পিউপাতে পরিণত হবার আগের সময়গুলোতে শুয়াপোকাদের মগজের স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। তারা সবকিছু দ্রুত শিখে ফেলে। এই সময়ে জানা অভিজ্ঞতা পরিণত বয়স পর্যন্ত টিকে থাকে। পিউপা অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে এর কোন পরিবর্তন হয় না। পুরনো স্মৃতিকে সহজে তারা পুনরুদ্ধার করতে পারে।

শৈশবের স্মৃতিকে পতঙ্গদের এই পুনরুদ্ধার করতে পারার মধ্যে পরিবেশগত এবং বিবর্তনবাদের বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর আছে। শুঁয়াপোকারা তাদের শৈশবে যে প্রজাতির গাছে জন্মেছিল, যার পাতা খেয়ে তারা পুষ্ট হয়েছিল, বড় হয়ে প্রজাপতি বা মথে পরিণত হওয়ার পরও তারা তা ভোলে না। খাদ্যের খোঁজে বিভিন্ন গাছে ঘুরে বেড়ালেও স্ত্রীপতঙ্গ ডিম পাড়ার জন্য শৈশবের পরিচিত প্রজাতির গাছে ফিরে আসে। এই আচরণ বিশ্লেষণ করে পতঙ্গের বিচরণক্ষেত্র, অভ্যাস এবং নতুন প্রজাতির বিকাশসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব।

সাধারণত: সামাজিক পতঙ্গদের শিক্ষা, স্মৃতিশক্তি ও আচরণ বিষয়ে গবেষণা করা হয়। যেমন- মৌমাছি, পিঁপড়া ইত্যাদি। মার্থ ওয়েজ এর দলের গবেষণা মূলত নি:সঙ্গ বা একাকী পতঙ্গ নিয়ে। যেমন- প্রজাপতি, বোলতা, লম্বা পা ওয়ালা ম্যান্টিড ইত্যাদি। কারণ এইসব অসামাজিক পতঙ্গদের আচরণ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের জানাশোনার পরিধি খুবই কম।

ওয়েজ ও তার সহযোগী গবেষকগণ এইসব স্বনির্ভর, বহুমুখী কর্মতৎপর পোকারা চারপাশের পরিবেশের সাথে জীবনযাপনে কিভাবে দক্ষ হয়ে ওঠে সে বিষয়ে আরও নিবিড় অনুসন্ধান চালিয়ে যাবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।

0 টি মন্তব্য:

Post a Comment

আপনার প্রাসঙ্গিক মন্তব্য, ভাবনা, ভিন্নমত প্রকাশ করুন। প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে না চাইলে ইমেইল করুন।