Thursday, March 6, 2008

আধুনিক অঙ্গসংস্থানবিদ্যার কাহিনী ১

ডা: অ্যান্ড্রিয়া ভেসালিয়াস

সুশান্ত বর্মন

বিজ্ঞান অর্থ বিশেষ জ্ঞান। যা অন্যসব জ্ঞানের মতো নয়। যে জ্ঞান আমাদেরকে এগিয়ে দেয়। মনের কঠিন অন্ধকার দূর করে, দিগন্ত আলোকিত করে। আমাদের মুখোমুখি করে দারুণ সত্যের। আমাদের শতচর্চিত ধারণা বা বিশ্বাসগুলো ভয় পায় বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানের সগৌরব যাত্রাপথে নানা বিঘ্ন ঘটাতে চায় এবং ঘটায়। তবুও বিজ্ঞান থেমে থাকেনি। নানা আক্রমণের মুখেও মহাকাশবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের একাধিক শাখা সমাজের মূর্খ নেতাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে। সত্য প্রকাশের দায়ে নির্যাতিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে সক্রেটিস, ব্রুনো প্রমুখের নাম চিরস্মরণীয়। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের চাইতে সামাজিক নীতির হাতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বেশি নির্যাতিত হয়েছেন। কখনও কখনও বিজ্ঞান ও ধর্ম মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। কখনও একটি অসাধারণ তথ্য বিজ্ঞানীদের হাতে হঠাৎ করে এসে গেছে, কখনও কোন একটি জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে অভাবিতভাবে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমনি অনেক ঘটনা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বিজ্ঞান যে কখনও কোন পুরনোবাদীর ইচ্ছার কাছে থেমে থাকেনি এইসব ঘটনার কাছ থেকে আমরা তাই শিখে নেই।

ব্রাসেলস এর এক সম্ভ্রান্ত ফ্লেমিশ বংশে আধুনিক অঙ্গসংস্থানবিদ্যার রূপকার ডা: অ্যান্ড্রিয়া ভেসালিয়াস ১৫১৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্রাসেলস এর স্কুল, লোভেন এর কলেজ ও প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। তাঁর সময়কালের সমাজের নৈতিক কাঠামো কেমন ছিল ইতিহাস সচেতন ব্যক্তিরা সহজেই বুঝতে পারবেন। দ্বিতীয় শতকে গ্রীসে জন্মেছিলেন গ্যালেন নামক একজন প্রভাবশালী চিকিৎসা ব্যক্তিত্ব। অনেক সুখ্যাতি ছিলো তাঁর। তিনি তাঁর একটি বইতে মন্তব্য করে গিয়েছিলেন যে- কুকুর, শুকর, ছাগল, খরগোশের সাথে মানুষের শরীরের হাড়ের গঠন- সজ্জাপদ্ধতি, সংখ্যা একই রকম। গ্যালেনের এমন মন্তব্যের কথা জেনে অনেকের হাসি আসতে পারে; কিন্তু বাস্তব সত্য হলো এখনও এদেশে অনেকে মনে করে দুজনে মানুষ হলেও নারীর ও পুরুষের শরীরের হাড়ের সংখ্যা সমান নয়। উদারবাদী বলে পরিচিত উচ্চশিক্ষিত অনেকে মনে করেন কথাটা সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক সত্যি অর্থাৎ নারী এবং পুরুষ পরস্পরের মধ্যে কোন এক জনের একটি বিশেষ হাড়ের আকৃতিতে নাকি পার্থক্য আছে। মহান গ্যালেনের ধারণাকে সত্য মনে করে নিয়ে ডাক্তারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে এ্যানাটমি শেখাতেন। কুকুর, বিড়াল, শুকর, খরগোস, ছাগল, শেয়াল ইত্যাদি প্রাণীর শরীর ব্যবচ্ছেদ করে ছাত্রদেরকে মানুষের শরীরের অঙ্গ সংস্থান বোঝাতেন। সেকালের কুসংস্কার এতো প্রবল ছিলো যে মৃত মানুষের শরীর ব্যবচ্ছেদ করা নৈতিক দিক থেকে মহাঅপরাধ বলে বিবেচনা করা হতো। অর্থাৎ গ্যালেনের মৃত্যুর পর থেকে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে শেখানো হতো যে মানুষের শরীরের হাড়ের সংস্থানের সাথে কুকুর, বিড়াল, শুকর, খরগোশ, ছাগল, শেয়াল ইত্যাদি প্রাণীর শরীরের হাড়ের গঠন-সন্নিবেশ ও প্রত্যঙ্গ সজ্জার কোন অমিল নেই।
১৫৩৩ সালের শরৎকালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলজিয়াম থেকে একটি নতুন ছাত্র আসে। সমস্ত ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে নামডাকওয়ালা প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় ডাক্তারী শেখার জন্য খুবই বিখ্যাত ছিল। সেখানকার এনাটমী শিক্ষা গ্যালেন প্রভাবেব বাইরে নয়, তবুও শুধু নামের কারণেই ছাত্র সংখ্যার কোন কমতি ছিল না। বেলজিয়াম থেকে আসা ছাত্রটির নাম ভেসালিয়াস। তিনি এনাটমীর ক্লাশে শুকর-কুকুরের ব্যবচ্ছেদ দেখতে দেখতেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেনÑ গ্যালেনের বক্তব্যে নিশ্চয় ভুল আছে। হাজার বছর ধরে প্রচলিত বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ভেসালিয়াসের ছিলো। কিন্তু যথাযথ প্রমাণ এখনও তাঁর সংগ্রহ করা হয়নি। তাই তিনি প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। এর মধ্যে একদিন তিনি তাঁর এই ধারণার কথাটা প্রকাশ করলেন। বন্ধুরা কেউ কেউ হেসেছিলো, কেউবা পাগল বলে ব্যঙ্গ করেছিলো। কিন্তু গ্যালেনপন্থীরা প্রচন্ড খেপে গেলেন। ভেসালিয়াসকে মিথ্যাবাদী, পাগল, পাপী ইত্যাদি বলে বেড়াতে লাগলেন। অতি উৎসাহী কেউ কেউ শারীরিক আঘাতের হুমকীও দিয়েছিলেন। কিন্তু ভেসালিয়াস বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করতেন। তাই পরাজয় স্বীকার করেননি। অপেক্ষা করছিলেন একটি যথার্থ প্রমাণের। সম্পূর্ণ মানব কংকাল হলে সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু লাশ ব্যবচ্ছেদ করা সামাজিক আইন অনুযায়ী অনৈতিক ও অন্যায়। তা অপরাধ বলে শাস্তিযোগ্য। তাই সেদিকে যাওয়া ভেসালিয়াসের পক্ষে অসম্ভব ছিলো। অভাবিতভাবেই একদিন হঠাৎ করে তিনি একটি সম্পূর্ণ কংকাল পেয়ে গেলেন। সেকালে সমস্ত ইউরোপে ফাঁসীতে আসামীদের হত্যা করা একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি ছিলো। শহরের বাইরে এক নির্জন পাহাড়ী এলাকায় আসামীদেরকে ফাঁসী দেয়া হতো। ভেসালিয়াস একদিন বৈকালিক ভ্রমণ করতে করতে চিন্তামগ্ন অবস্থায় পাহাড়ের পাদদেশে ফাঁসী দেয়ার জায়গাটায় চলে এলেন। দেখলেন দুই এক মাস আগে ফাঁসী দেয়া এক আসামীর শুকনো কংকালটি ফাঁসী মঞ্চের পাটাতনে পড়ে আছে। লোকজনের চোখ এড়িয়ে কয়েকরাত ধরে বহন করে তিনি সম্পূর্ণ কংকালটি নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। জীবনে কখনো মানুষের কংকাল না দেখা ভেসালিয়াস একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ শুরু করে দিলেন। অনেক পরিশ্রম করে হাড়গুলো ধাতব তার দিয়ে জোড়া দিয়ে একটি সম্পূর্ণ মানব কংকাল সাজিয়ে ফেললেন। সম্পূর্ণ সাজানো কংকালটির দিকে তাকিয়ে ভেসালিয়াস বুঝে ফেললেন এতদিন যা শিখেছেন তা মোটেও সত্য নয়। এতকালের ধারণা-বিশ্বাস, শিক্ষকদের নৈতিক অবস্থান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষানীতি, সামাজিক সমর্থন সবগুলোই মানুষের হাড়সজ্জা বিষয়ে সম্পূর্ণ কল্পনাশ্রয়ী ও অপপ্রচার মাত্র। মানুষের শরীরের হাড়ের সংখ্যা, গঠন ও সন্নিবেশ পদ্ধতির সঙ্গে গ্যালেন বর্ণিত কুকুর-শিয়াল প্রভৃতি প্রাণীর হাড় সংস্থানের কোন মিল নেই। সামাজিক চাপ এতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও হিংস্র ছিলো যে গ্যালেনের মৃত্যুর পর থেকে ভেসালিয়াস পর্যন্ত জন্ম নেয়া অসংখ্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী এই সাধারণ তথ্যটুকুই এতদিন আবিষ্কার করতে পারেননি। ভেসালিয়াসের অমর আবিষ্কারের কারণেই আমরা জানি মানুষের হাড়ের চাইতে পশুর হাড়ের সজ্জার যথেষ্ঠ পার্থক্য রয়েছে, জানি নারী ও পুরুষের হাড়ের সংখ্যায় কোন পার্থক্য নেই। উভয়েরই ২০৬টি করে হাড় রয়েছে। এমনকি দুজনের কোন একটি বিশেষ হাড়েও কোন বিকৃতি নেই।

0 টি মন্তব্য:

Post a Comment

আপনার প্রাসঙ্গিক মন্তব্য, ভাবনা, ভিন্নমত প্রকাশ করুন। প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে না চাইলে ইমেইল করুন।