Thursday, March 6, 2008

আধুনিক অঙ্গসংস্থানবিদ্যার কাহিনী ২

মানুষের কংকাল বিষয়ে হাজার বছরের প্রচলিত বিশ্বাস এর বিপরীতে ভেসালিয়াসের এই আবিষ্কার সারা ইউরোপে দারুণ সাড়া ফেলে দিলো। তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন। বিভিন্ন জায়গায় দেয়া বক্তব্যে ভেসালিয়াস সেই অপরাধীর কংকাল আবিষ্কার এর বিষয়টি উল্লেখ করে বলতেন- আমি যদি গভীর রাতে কংকাল দেখে আধিভৌতিকতাকে বিশ্বাস করে ভয় পেতাম তাহলে আজ সত্যকে চিনতে পারতামনা। যদি মহান গ্যালেনকে ধ্রুবসত্য বলে বিশ্বাস করতাম তাহলে আজ জানা হতো না বৈজ্ঞানিক সত্যটি। বন্ধু ক্যালকার এর আঁকা ছবি ও নিজের পর্যবেক্ষণজাত তথ্য-উপাত্ত, নমুনা উপস্থাপন করে ভেসালিয়াস তাঁর নিজের বক্তব্যের পক্ষে একটি শক্তিশালী জনমত গড়ে তুললেন। নিখুঁত চিত্র ও বিস্তারিত তথ্যে বেশিরভাগ জনগণ নিজেদের বিশ্বাসের সাথে বৈজ্ঞানিক সত্যের পার্থক্য বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু গ্যালেনপন্থীরা নিজেদেরকে বোকা ভাবতে চাইলেন না। তাই বাড়িতে ঢিল, রাস্তায় হুমকী, মারধর ইত্যাদি সহিংস পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে ভেসালিয়াসকে বিরক্ত করতে লাগলেন। বাধ্য হয়ে মনের দুঃখে ভেসালিয়াস প্যারিস ছেড়ে ইটালিতে চলে এলেন। ইটালির একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সমস্ত ইউরোপের মধ্যে ইটালি অনেকটা উদার ও সহনশীল সমাজ তৈরি করতে পেরেছিলো। রক্ষণশীলতার বন্ধ কপাট ইটালিতে অনেকাংশেই খোলা ছিলো। সেখানকার কর্তৃপক্ষ প্রাচীন পুস্তককেই একমাত্র সত্যি কথা বলে বিশ্বাস করতে নারাজ ছিলেন বলেই মেধাবী গবেষকদের কাছে ইটালি দেশটির একটি আলাদা মর্যাদা ছিলো। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমির অধ্যাপক পদে ভেসালিয়াস নিযুক্ত হন মাত্র ২৩ বৎসর বয়সে, ১৫৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে।
ভেসালিয়াস বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এভাবে চিরকাল বক্তৃব্য দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই যদি একটি বই লেখা যেতো তাহলে খুব ভালো হতো। পাদুয়ায় শিক্ষকতা ও গবেষণার আঁকে ফাঁকে কয়েক বছরের নিরলস চেষ্টার পর একটি গ্রন্থ লেখা সম্পূর্ণ করলেন। সমকালীন নীতিবাদীদের অনেক বাঁধা-বিঘ্ন পেরিয়ে প্রকাশিত হওয়া গ্রন্থটির নাম- ‘ডি ফ্যাব্রিকা করপোরিস হিউম্যানি’। বাংলায় ‘মানব দেহের অঙ্গসংস্থান’। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত এই বইটি একটি বিশাল স্থান গ্রহণ করে আছে। মানব শরীরের অভ্যন্তরস্থ প্রত্যঙ্গগুলো সম্পর্কে এটাই প্রথম যথাযথ বৈজ্ঞানিক তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ। মানুষের হাড়, মাংশপেশী, প্রত্যঙ্গের গঠন, কার্যপ্রণালী ইত্যাদি সম্পর্কে নিখুঁত আলোচনা ও বন্ধু ক্যালকার-এর আঁকা চিত্র প্রাচীন বিজ্ঞানের অনেক মীথ ভেঙে ফেলেছে। তাঁর আলোচনা পদ্ধতি ছিলো সরল ও প্রাণবন্ত। তাঁর বর্ণনাপদ্ধতি এখনও আধুনিক শারীরবিদদের পথ প্রদর্শন করে চলেছে। হাড়, পেশী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ও ক্যালকার এর আঁকা প্রামাণ্য চিত্র দিয়ে ভেসালিয়াস গ্যালেনপন্থীদের অবস্থান দূর্বল করে দিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান ভেসালিয়াসের কীর্তিতে সমৃদ্ধ হলেও কতিপয় ব্যক্তিবর্গের মন তুষ্ট হয়নি। ভেসালিয়াস তাঁর ‘ডি ফ্যাব্রিকা করপোরিস হিউম্যানি’ গ্রন্থটি প্রকাশের কাজ তদারক করতে একদিন ইটালি ছেড়ে বেলজিয়ামে যান। প্রিয় ও মেধাবী ছাত্রটিকে তাঁর অবর্তমানে কাজ চালিয়ে যাবার দায়িত্ব দেন। কয়েক দিন পর ফিরে এসে দেখেন তাঁর প্রিয় ছাত্রটি কূটবুদ্ধি ও গ্যালেনপন্থীদের সাথে ভালো যোগাযোগের সুযোগে নিজ অবস্থান পাকা করেছে। ছাত্রটি তাঁর মেধাবী কর্মকৌশলে ভেসালিয়াসকে সরিয়ে নিজেকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেবার কাগজপত্র তৈরি করে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভেসালিয়াসের সাথে কোন কথা বললেন না; তাঁর দেয়া কোন যুক্তিকেই তাঁরা বহন করলেন না। অপমানিত ভেসালিয়াস দারুণ লজ্জায় নিজেকেও গুটিয়ে নিলেন। তাঁর এতদিনের গবেষণা-পড়াশোনা নিজের কাছেই ভুল বলে মনে হতে লাগলো। যে মানুষের মঙ্গলের জন্য তাঁর এত চেষ্টা তার কোন মূল্যই চারপাশের মানুষরা গ্রহণ করতে পারছে না দেখে তিনি প্রচণ্ড হতাশা বোধ করলেন। আসলে ভুল সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। তিনি তাঁর সমকালের তুলনায় অনেক অগ্রগামী চিন্তার মানুষ ছিলেন। হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মানুষের মঙ্গলের জন্য অযথা আর চিন্তা করবেন না। সম্রাট চার্লস এর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নতুন কাজে যোগ দিলেন। এতদিনের দরিদ্রতা নিমেষেই দূর হয়ে গেলো। রাজার সংস্পর্শে এসে মুহূর্তেই তার অনেক টাকা উপার্জিত হয়ে গেল। ফ্রান্সের সবচেয়ে অভিজাত ব্যক্তিবর্গের মাঝে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ফ্রান্সের বেশ খ্যাতিমান চিকিৎসক হিসেবে একজন বিশেষ ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। বর্ণাঢ্য জীবন আর মোহনীয় নারীদের মাঝে সারাক্ষণ বাস করলেও ভেসালিয়াসের মন পড়ে থাকতো পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। কিন্তু ফিরে যাবার পরিবেশ ছিলো না আর। তাই মনের দুঃখ মনে চেপে রেখেই তিনি হাস্যপ্রিয় নারীদের কোলাহলে মিশে যেতেন। সমাজনেতা, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত মূর্খতার প্রভাবে এভাবেই একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর অপমৃত্যু হলো।
বিশ বছর পরে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক গাব্রিয়েল ফেলোপিয়াস বুঝতে পারেন মানব শরীর বিষয়ক সত্য তথ্যটি। তিনি গ্যালেনের তথ্যের অসারতা ও ভেসালিয়াসের যথার্থতা প্রমান করে ও ‘ডি ফ্যাব্রিকা করপোরিস হিউম্যানি’ গ্রন্থটির প্রভূত প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। একটি চিকিৎসা বিষয়ক ম্যাগাজিনে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়। সবাই নতুন করে ভেসালিয়াসকে বিচার করতে চাইলেন। তরুণ ডাক্তাররা সবাই আধুনিক ও কুসংস্কারমুক্ত মনের ছিলো। তারা অনেকেই নিজে নিজে গোপনে পরীক্ষা করে দেখে গ্যালেনের দেয়া ভুল তথ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলো। প্রশাসন ও নীতিবাদীদের নির্যাতনের ভয়ে এতকাল চুপ থাকলেও এখন তারা কোন বাধা মানলো না। অপেক্ষাকৃত মুক্ত মনের নতুন কর্তৃপক্ষ তাদের পূর্বতনদের সিদ্ধান্তের অসারতা বুঝতে পারলেন। তাঁরা ভেসালিয়াসকে পূর্বপদে পুনর্বহাল করে চিঠি দিলে তিনি আনন্দিত হয়ে ওঠেন। মূর্খ প্রবীণদের ভুল তরুণরা বুঝতে ও সংশোধন করতে চাইছে জেনে তিনি আশান্বিত হন। ফিরে আসতে চাইলেন পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু আসার পথে এক শক্তিশালী ঝড়ে জাহাজডুবি হয়ে তিনি সহ জাহাজের সমস্তু যাত্রীর সলিলসমাধি ঘটে। অনেক খোঁজাখুজি করেও জাহাজের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কয়েক মাস পর তীর্থযাত্রীদের একটি জাহাজ সামুদ্রিক ঝড়ে দিকবিভ্রান্তির ফলে চলে আসে ‘জান্তে’ নামক একটি দ্বীপে। ঝড় থামলে তীর্থযাত্রীদের সবাই দ্বীপের বালুতটে একটি জাহাজের ভগ্নাংশ ও বেশ কয়েকটি কংকাল দেখতে পেলেন। সবাই একটি লাশের পাশে দেখলেন ‘ডি ফ্যাব্রিকা করপোরিস হিউম্যানি’ নামক গ্রন্থটি। তাদের মধ্যে কারও কারও গ্রন্থটি পড়া ছিলো। তারা উপকূল থেকে একটু উচু জায়গায় ভেসালিয়াসের কংকালটি গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে রাখলেন। একটি কাঠে তাঁর নাম লিখে মাথার কাছে পুঁতে রাখলেন।
এক তরুণ বিজ্ঞানসচেতন ও মৌলিক চিন্তার অধিকারী বিজ্ঞানী ভেসালিয়াস তাঁর চারপাশের সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের চাইতে এক পা এগিয়ে ছিলেন। সময়ের চাইতে অগ্রগামী এই ব্যক্তিত্বের প্রজ্ঞাকে তাই তাঁর সমাজের নেতারা বুঝে উঠতে পারেননি। এখনকার মতো সেকালেও সব সামাজিক নেতারা জনগণকে নিজেদের চাইতে মূর্খ ভাবতেন। তাই ভেসালিয়াসের প্রজ্ঞাকে তাঁরা মাপতে পারেননি। বুঝতে পারেননি এই অমর চিকিৎসাবিজ্ঞানীর যাথার্থ। কিন্তু সত্য তথ্য যা তা কখনও চাপা থাকেনি। কুসংস্কারবাদী শক্তিমানদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে বিফল প্রমাণিত করে আমরা নিজেরাও আজ জানি যে মানুষের হাঁড়ের বিন্যাস, পেশী সংস্থান, বিভিন্ন অঙ্গের গঠনের সাথে কুকুর-শুকরের হাঁড় বিন্যাস, পেশী সংস্থান বা বিভিন্ন অঙ্গের গঠন বা কার্যাবলীর কোন মিলই নেই। এটাই বৈজ্ঞানিক সত্য। বিশ্বাসকে আঘাত করে করুক তাতে সত্য বসে থাকেনি। বিশ্বাসবাদী গ্যালেনপন্থীরাই যে ভুল ছিলো তা আজ আর কোন ভীততথ্য নয়। এখন শিশুরাও জানে যে নারী-পুরুষের হাড়ের সংখ্যায় কোন পার্থক্য নেই; কারও কোন বিশেষ হাঁড়ও বিকৃত নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান যতদিন বিজ্ঞান সম্মত থাকবে, যদি চিকিৎসা বিজ্ঞান কখনো বিশ্বাস নির্ভরতার পাতা ফাঁদে পা না দেয় তাহলে চিরকাল প্রশংসার সাথে স্মরণ করবে ‘আধুনিক এনাটমী শাস্ত্রের জনক’ ডা: অ্যান্ড্রিয়া ভেসালিয়াস এর অমর কীর্তিকে।

0 টি মন্তব্য:

Post a Comment

আপনার প্রাসঙ্গিক মন্তব্য, ভাবনা, ভিন্নমত প্রকাশ করুন। প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে না চাইলে ইমেইল করুন।